শিল্পের ধারাবাহিকতা ও রূপান্তর : একটি কেস স্টাডি

“Tête de taureau”, ১৯৪২, পাবলো পিকাসো

১.
প্যারিসের পিকাসো মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে একটি আর্টিফ্যাক্ট ‘Tête de Taureau’ বা ‘ষাঁড়ের মাথা’, অবশ্যই পাবলো পিকাসো কর্তৃক নির্মিত। এটি বিংশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একট আর্টিফ্যাক্ট। শিল্পবোদ্ধারা এই ছোট ভাস্কর্যের সারল্যের জন্য একে হতবুদ্ধিকর বলে রায় দিয়েছেন। পরিষ্কারভাবেই আমরা আর্টিফ্যাক্টে একটি ষাঁড়ের মাথা খুঁজে পাই। কিন্তু আর্টিফ্যাক্টটি তৈরি করা হয়েছে জঞ্জালের মাঝে খুঁজে পাওয়া একটি পুরনো সাইকেলের সিট ও হ্যান্ডল-বার একত্র করে। ব্যস! দু’টো আপাত দূরবর্তী কিন্তু সম্পর্কিত বস্তুকে জোড়া লাগিয়ে পিকাসো একেবারে ভিন্ন একটি ইমেজ তৈরি করে ফেলেছেন যা সচরাচর দৃষ্টিতে অদৃশ্য থেকে যায়।

ভাস্কর্যটির বার্তা এক দিক থেকে খুবই সোজাসাপ্টা। এটা শুধুমাত্র দু’টো বস্তুকে রিকন্টেক্সচুয়ালাইজ করছে না, বরং সবসময় চোখের সামনে থাকা দু’টো বস্তুর রূপান্তরও ঘটিয়েছে। হ্যান্ডলবার আর সিট এখন আর সাইকেলের দু’টো ভিন্ন কার্যকরী অংশ নয়, বরং ষাঁড়ের মাথায় পরিণত হয়ে একটি মাত্র কার্যকরী অর্থ বহন করছে। কিন্তু আমরা চাইলে, শিল্পের ইতিহাসের কথা মাথায় রেখে আর্টিফ্যাক্টটির গভীরতর অর্থ খুঁজে নেয়া সম্ভব।

২.
মানুষের সহস্র বছরের শিল্পচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো- ধারাবাহিকতা ও রূপান্তরের চিরকালীন টানাপড়েন; একই জাতের ভিজ্যুয়াল আইডিয়াগুলোকে যুগ যুগ ধরে ধরে ধারণ করে রাখার বিপরীতে সেই আইডিয়াগুলোর মাঝে সামান্য কিংবা মুখ্য পরিবর্তন এনে রূপান্তরের চেষ্টা। ধারাবাহিকতা ও রূপান্তরের মধ্যকার এই টানাপড়েন উপলব্ধি করার জন্য কখনো কখনো ভিজ্যুয়াল সূত্রের দিকে তাকাতে হয়, কখনো ধারণাগত পরিভাষার সাহায্য নিতে হয়। শিল্পমাধ্যমগুলোয় এই ধারাবাহিকতা ও রূপান্তরের ধারণা উপলব্ধি করার মধ্য দিয়ে একজন শিল্পী তার শিল্পের মাধ্যমে কীভাবে নিজের পৃথিবীকে দেখে তা বুঝে ওঠা সম্ভব এবং একই সাথে সেই শিল্পী কীভাবে পূর্ববর্তী শিল্প-নিদর্শনগুলোকে মূল্যায়ন ও পুনঃব্যাখ্যা করছে- সেটাও জানা সম্ভব। যেমন- কয়েক হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে Tree of Life বা জীবনবৃক্ষের যে ধারণা জন্ম নিয়েছিল তা শুরুতে আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করতো। সময়ের সাথে সাথে সেই প্রতীক রূপান্তরিত হয়ে জন্ম দিয়েছে নানা ধরনের অর্থের, কিন্তু ভিজ্যুয়াল ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এই জীবন-বৃক্ষের ধারণাটি কোথাও কলামের রূপ নিয়েছে, কোথাও নিয়েছে হিরোর রূপ, কখনওবা বজায় রেখেছে নিজস্বতা। সবই ঘটেছে সময়ের সাথে নানা জনপদের সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় পরিস্থিতির কারণে। প্রাচীন আইডিয়াকে ভিজ্যুয়ালি পরিবর্তন না করে ধারণাগতভাবেও রূপান্তর করা সম্ভব। আবার উল্টোটাও ঠিক, ধারণাগত পরিবর্তন না এনে ভিজ্যুয়াল পরিবর্তন আনা সম্ভব। পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করছে শিল্পীর ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ এবং তার সময়ের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতির ওপর। আমরা যদি শিল্পে উপস্থিত প্রতীকী ভাষা এবং রূপান্তর ও ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে শিল্পকলার সিনথেসিস না বুঝি তাহলে যে কোনো শিল্প-নিদর্শনকে ভুল বুঝবো। আমাদের পূর্বধারণা আমাদেরকে কোনো নির্দিষ্ট পেইন্টিং বা ভাস্কর্যের আসল উদ্দেশ্য উপলব্ধিতে বাধা দেবে।

৩.
আলোচ্য আর্টিফ্যাক্টটি শুধুমাত্র একটি ভিজ্যুয়াল স্টেটমেন্ট নয়, এর একটি ভাবগত দিকও আছে। পিকাসো কিন্তু কোনো সম্পর্কহীন প্রাণীকে বেছে নেন নি। জঞ্জালের মাঝে অনেক ধরনের ইমেজ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তিনি খুঁজে পেয়েছেন এই ষাঁড়কে। আর শিল্পের ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের দিকে নজর দিলে দেখতে পাই- ষাঁড় প্রতিনিধিত্ব করছে পৌরুষের। ফ্রান্সের লাসকো গুহার প্রায় ১৫ হাজার বছরের পুরনো গুহাচিত্রের কথা মনে করতে পারি যেখানে একটি বিশাল ষাঁড় পুরুষের পৌরুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রাচীনকাল থেকেই ষাঁড়কে পুরুষের উর্বরতার প্রতীক বলে মানা হতো। শিল্পেও এই ধারণাটি ঢুকে গেছে। সময়ের সাথে ষাঁড় ক্ষমতার প্রতীকেও পরিণত হয়েছে। নানা ধর্মের মধ্যে ষাঁড় গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকে পরিণত হয়েছে, কোনো কোনো অঞ্চলে ষাঁড় দেবতা হিশেবেও আবির্ভূত হয়েছে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মিথেই ষাঁড়ের সাথে পৌরুষ ও ক্ষমতার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাসজুড়েই শক্তিমান রাজা ও সম্রাটদেরকে ষাঁড়রূপে কিংবা ষাঁড়ের মুকুট পরিহিত অবস্থায় নানা পেইন্টিং ও ভাস্কর্যে খুঁজে পাওয়া যায়। পিকাসো শিল্পের ইতিহাসের সেই ধারাবাহিকতাকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বদলে ফেলেছেন এর ভাবগত অর্থ।

পাবলো পিকাসো একজন স্প্যানিশ, যিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দশকের পর দশক ফ্রান্সে বসবাস করেছিলেন। এই তথ্যটি মাথায় রাখলেই আলোচ্য আর্টিফ্যাক্টের একটি ভিন্ন অর্থ আবছাভাবে মাথায় ঘুরতে থাকে। আমরা সবাই জানি, স্প্যানিশ সংস্কৃতিতে ষাঁড় কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘Bull Fight’ এবং ‘Running of the Bulls’ স্প্যানিশদের আইকনিক অনুষ্ঠান, তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ষাঁড়ের ইমেজ একজন স্প্যানিশ হিশেবে পিকাসোর কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তা বলাই বাহুল্য।

পাবলো পিকাসো শিল্পের ইতিহাসে ষাঁড়ের প্রতীকী গুরুত্ব ও ধারাবাহিকতার ব্যাপারে ভালোভাবেই জানতেন। একইসাথে স্প্যানিশ সংস্কৃতিতে ষাঁড়ের গুরুত্বও তাঁর মাথায় ছিল। তিনি বহুবছর ধরে মাতৃভূমি থেকে দূরে বসবাস করছিলেন । মাতৃভূমির ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি তাঁর মনে যে দাগ কেটেছিল তাকেই হয়তো মরচে পড়া সাইকেলের হ্যান্ডলবারে খুঁজে পেয়েছিলেন। একইসাথে এই ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে তাঁর স্প্যানিশ ও ফরাসী পরিচয়ের মধ্যে টানাপড়েনও স্পষ্ট হয়। সব ধরনের ভিজ্যুয়াল ও কনসেপচুয়াল আইডিয়া তাঁর ব্যক্তিগত আইডেন্টিটির (শিল্পী পরিচয় ও স্প্যানিশ পরিচয়) সাথে একত্রিত হয়ে ‘Tête de Taureau’ জন্ম নিয়েছে। পিকাসো পুরনো একটি ভিজ্যুয়াল প্রতীককে গ্রহণ করে ব্যক্তিগত সময়ের দর্পণে ফেলে সেটাকে রূপান্তরিত করে ভিন্ন অর্থ ও তাৎপর্যের জন্ম দিয়েছেন।

৪.
Tête de Taureau’ নির্মাণের পেছনকার এই ব্যাখ্যাগুলো উপলব্ধি না করে কোনো ব্যক্তি যদি দাবি করে বসেন যে- পিকাসোর ‘ষাঁড়ের মাথা’ আসলে প্রাচীন কুসংস্কারমূলক কৃষ্টির প্রতিনিধিত্ব করছে, যা আমাদের ধ্যানধারণার সাথে যায় না বিধায় একে অপসারণ করতে হবে- তাহলে সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির শিল্পচেতনার খামতি এবং আলোচ্য বিষয়ে অজ্ঞতা স্পষ্ট হয়। তাই যে কোনো শিল্প-নিদর্শন বুঝে ওঠার জন্য শিল্পের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও রূপান্তরের সংস্কৃতির ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে- যখন কোনো আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্ক নির্মাণের চেষ্টা নজরে পড়ে।

.
৪ জুন,২০১৭।

 

 

লেখাটি নিয়ে মন্তব্য করুন